বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যা:
বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের ‘বসন্তকাল’ চলছে। কিংবা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে নতুন
উচ্চতায় নিয়ে যেতে কাজ করছে দুই দেশের সরকার—এমন সব কথার
ফুলঝুড়ি হরহামেশাই শোনা যায়। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা ভিন্ন। এতো বন্ধুত্বের পরও দুই দেশের সীমান্তকে
রক্তপাতমুক্ত করা যাচ্ছে না কিছুতেই। আর সবক্ষেত্রে ভিকটিম বাংলাদেশি নাগরিক। গত
এক দশকে সীমান্তে ২৯৪ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। এটা
মানতে হবে যে, বাণিজ্য ঘাটতি
কমানো, সাংস্কৃতিক বিনিময়, সীমান্ত হাট স্থাপন, ছিটমহল বিনিময় ও অপদখলীয় ভূমি নিষ্পত্তির
মতো বেশ কিছু ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে দুটি দেশ। কিন্তু সীমান্তে নির্বিচারে
বাংলাদেশি
নাগরিক হত্যাকাণ্ডের আড়ালে পড়ে যাচ্ছে এসব অর্জন। গত বছরের চেয়ে এ
বছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থাত ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের
পরিমাণ আরো বেড়েছে। ২০১৯ সালের প্রথম পাঁচ মাসে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ১৫।
সীমান্ত হত্যা বন্ধে ২০১১ সালে বিজিবি ও ভারতের বিএসএফের মধ্যে একটা চুক্তি
হয়েছিল৷ চুক্তিতে বলা হয়, সীমান্ত
পারাপারে মানুষ হত্যায় অস্ত্র ব্যবহার করবে না এই দুটি দেশ। কিন্তু চুক্তি করেও বন্ধ হয়নি সীমান্ত
হত্যা।
এবার আসুন জেনে নেয়া
যাক বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যা বলতে কি বোঝায়:
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যা দ্বারা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমানায়, মূলত ভারতীয়
সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক সাধারণ ও বেসামরিক বাংলাদেশি নাগরিকদের উপর
সংগঠিত নিয়মিত নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডকে বোঝানো হয়ে থাকে। সীমান্তে চোরাচালান ও
বাংলাদেশ থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিতর্কিত
শ্যূট-অন-সাইট (দেখামাত্র গুলি) নীতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বহাল আছে, যার প্রেক্ষিতে বিএসএফ কারণে কিংবা অকারণে
বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করতে পারে। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যাওয়া, হাট-বাজারে বিকিকিনি করা এবং কাজ খোঁজার
জন্য অনেক মানুষ নিয়মিতভাবে সীমান্ত পারাপার করে। এছাড়াও সীমান্তের শূন্যরেখার
কাছে জমিতে কৃষিকাজ কিংবা নদীতে মাছ ধরার জন্যও অনেক
মানুষকে সীমান্তপথ অতিক্রম করতে হয়। এর মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন ছোটখাটো এবং গুরুতর
আন্তঃসীমান্ত অপরাধে নিয়োজিত। সীমান্ত বাহিনী অবৈধ কার্যক্রম মোকাবেলার
বাধ্যতামূলক করা হয়, বিশেষ করে মাদক
চোরাচালান, যৌন কাজের জন্য
মানব পাচার, এবং জাল মুদ্রা
ও বিস্ফোরক পরিবহন। কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের বিরুদ্ধে ২০০০ সালের পর থেকে এ
পর্যন্ত প্রায় ১,৫০০ সাধারণ ও
বেসামরিক বাংলাদেশি হত্যার অভিযোগ আছে। অনেক ক্ষেত্রে নিরস্ত্র এবং অসহায়
স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ডের পরিষ্কার প্রমাণ
সত্ত্বেও, এখন পর্যন্ত কাঊকেই
হত্যাকাণ্ডের জন্য সুষ্ঠ তদন্ত ও বিচারের আওতায় আনা হয়নি।
ভারতীয় কর্মকর্তারা বিএসএফ-এর আচরণের পরিবর্তন এবং শ্যূট-অন-সাইট নীতি বাতিল
করতে নতুন আদেশ পাঠাতে অঙ্গীকার করেছেন। তারা অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপারকারী বা
পাচারকারীদের ধরতে অহিংস উপায় ব্যবহার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। যদিও তা
এখনোও বাস্তবে কার্যকর হয়নি। সীমান্তে অপরাধ রোধে ভারতে একটি কার্যকরী আদালত থাকলেও, সীমান্তের এসব অপরাধের ক্ষেত্রে দৃশ্যতঃ
বিএসএফ নিজেই বিচারক, জুরি এবং ঘাতক
হিসাবে কাজ করে।
হত্যাকান্ডের পরিসংখ্যান:
বাংলাদেশে ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা “অধিকার” এর রেকর্ড
অনুযায়ী, ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১০৬৪ জন
বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে বিএসএফ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুসারে
২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে বিএসএফ গুলি করে ও শারীরিক
নির্যাতন করে হত্যা করেছে ৪২ জন বাংলাদেশিকে। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৯৬ সাল
থেকে ২০০১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সীমান্তে ৩শ ১২ বার হামলা চালানো হয়। এতে ১২৪ জন
বাংলাদেশী নিহত হয়। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে ১৩০টি হামলায় ১৩ জন নিহত, ১৯৯৭ সালে ৩৯টি ঘটনায় ১১ জন, ১৯৯৮ সালে ৫৬টি ঘটনায় ২৩ জন, ১৯৯৯ সালে ৪৩টি ঘটনায় ৩৩ জন, ২০০০ সালে ৪২টি ঘটনায় ৩৯ জন নিহত হয়।
বিগত ১০ বছরে প্রায় ১,০০০ মানুষ বিএসএফ
কর্তৃক নিহত হয়, যার বেশিরভাগই
বাংলাদেশি। জাতীয় মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুসারে ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত
বিএসএফ হত্যা করেছে ৩৫ জনকে। এ সময় বিএসএফ ২২ বাংলাদেশীকে গুলি ও নির্যাতন করে
আহত করেছে আর অপহরণ করেছে ৫৮ জনকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে মাত্র ৭ দিনের
ব্যাবধানে ভারতীয়রা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ৩ বাংলাদেশীকে জোর-জবরদস্তি
অপহরণ করে নিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশিকে হত্যা
করেছে বিএসএফ সদস্যরা৷ ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশিকে৷ আহত হয়েছেন
৬৮ জন৷ এছাড়া বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে ৫৯ জনকে। তিন বছরে সীমান্তে বাংলাদেশি
হত্যায় ২০১৫ সাল শীর্ষে অবস্থান করছে৷ ২০১৫ সালে বিএসএফ হত্যা করেছে ৪৫জন
বাংলাদেশিকে।
১৯৯৬ - বর্তমান
১৯৯৬ সালে ১৩০টি হামলায় ১৩ জন নিহত।
১৯৯৭ সালে ৩৯টি ঘটনায় ১১ জন।
১৯৯৮ সালে ৫৬টি ঘটনায় ২৩ জন।
১৯৯৯ সালে ৪৩টি ঘটনায় ৩৩ জন।
২০০০ সালে ৪২টি ঘটনায় ৩৯ জন নিহত হয়।
২০০১ সালে ৯৪ জন নিহত হন।
২০০২ সালে ১০৫ জন নিহত হন।
২০০৩ সালে ৪৩ জন নিহত হন।
২০০৫ সালে ১০৪ জন নিহত হন।
২০০৬ সালে ১৪৬ জন নিহত হন।
২০০৭ সালে ১২০ জন নিহত হন।
২০০৮ সালে ৬২ জন নিহত হন।
২০০৯ সালে ৯৬ জন নিহত হন।
২০১০ সালে বিএসএফ ৭৪ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করে।
২০১১ সালে হত্যার শিকার হন ৩১ জন।
২০১২ সালে হত্যার শিকার হন ৩৮ জন।
২০১৩ সালে হত্যার শিকার হন ২৯ জন।
২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জনকে।
২০১৫ সালে বিএসএফ হত্যা করেছে ৪৫ জনকে৷
বিএসএফ কর্তৃক সংঘটিত সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকান্ড হচ্ছ ফেলানি
হত্যাকান্ড:
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কুড়িগ্রামের অনন্তপুর-দিনহাটা সীমান্তের খিতাবেরকুঠি
এলাকায় ০৭ জানুয়ারি ২০১১ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর সদস্যরা
ফেলানী খাতুন নামের এক কিশোরীকে গুলি করে হত্যা করে। বিএসএফ-১৮১
ব্যাটালিয়নের চৌধুরীহাট ক্যাম্পের জওয়ানদের এই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। ফেলানীর
বাবা নাগেশ্বরী উপজেলার দক্ষিণ রামখানা ইউনিয়নের বানার ভিটা গ্রামের নুরুল ইসলাম
নূরু/নজরুল ইসলাম নূর ১০ বছর ধরে নতুন দিল্লিতে কাজ করতেন। তার সঙ্গে সেখানেই
থাকতো ফেলানী। দেশে বিয়ে ঠিক হওয়ায় বাবার সঙ্গে ফেরার পথে, সীমান্তে কাটাতারের বেড়া মই বেয়ে পার
হওয়ার সময় কাঁটাতারের বেড়ায় কাপড় আটকে যায় ফেলানীর। এতে ভয়ে সে চিৎকার দিলে
বিএসএফ সদস্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং ফেলানীর লাশ পাঁচ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলিয়ে
রাখে। কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে
বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। বিএসএফ নিজস্ব আদালতে এ
ঘটনার জন্য দায়ী সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির পক্ষ
থেকেও বিএসএফের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে ফেলানী হত্যার বিচারের জন্য চাপ দেয়া হয়।
বিজিবির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,
২০১২
সালের মার্চে নয়াদিল্লীতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে ফেলানী
হত্যার বিচার দ্রুত শুরু করা হবে বলে আশ্বাস দেন বিএসএফের মহাপরিচালক। এরই ধারাবাহিকতায় বিএসএফ সদর দপ্তর ‘জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স কোর্ট গঠন করে এবং আদালতে
সাক্ষ্য দেয়ার জন্য বাংলাদেশের দুইজন সাক্ষী, একজন আইনজীবী এবং বিজিবির একজন প্রতিনিধিকে ভারতে যেতে বলা
হয়। সে অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কুড়িগ্রামের ৪৫ বর্ডার গার্ড
ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল জিয়াউল হক খালেদ, কুড়িগ্রাম আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর
আব্রাহাম লিংকন এবং ফেলানীর বাবা মো. নুরুল ইসলাম ও মামা মো. আব্দুল হানিফকে ভারতে
গিয়ে সাক্ষ্য দেয়ার অনুমতি দেয়।
বিএসএফের জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স আদালতে দুই দফা বিচারে ফেলানীকে গুলি করে
হত্যায় অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে খালাস দেওয়া হয়। এরপর ন্যায়বিচার চেয়ে
ভারতের সুপ্রিম কোর্টে পরপর দুটি রিট করা হলেও আজও শুনানি হয়নি। এই হত্যাকাণ্ড
নিয়ে খোদ ভারতেও হয়েছে অনেক সমালোচনা। মামলা ও তার বিচার নিয়েও রয়ে গেছে অনেক
বিতর্ক।
সূত্র:
হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ(www.hrw.org),
ডয়েচে
ভেলে(www.dw.com), বিবিসি(www.bbc.com)