ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশের একটি ভূখণ্ড, যা ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে অবস্থিত। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে ফিলিস্তিন। এটি ইহুদি ধর্ম ও খ্রিস্টধর্মের জন্মস্থান। ভৌগোলিক অবস্থান ও দুটি প্রধান ধর্মের জন্মস্থান হওয়ায় স্বভাবতই ফিলিস্তিনের রয়েছে ধর্ম, সংস্কৃতি, বাণিজ্য ও রাজনীতির এক দীর্ঘ ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইতিহাস। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের এই সম্পূর্ণ ভূ-খণ্ড বা এর কোন কোন অংশ বিভিন্ন রকমের মানুষদের দ্বারা পরিচালিত ও শাসিত হয়ে আসছে। এদের মধ্যে আছে- কেনানীয়, আমরীয়, প্রাচীন মিশরীয়, ইসরায়েল বংশের ইহুদি, ব্যাবিলনীয়, পারস্য, প্রাচীন গ্রিক, রোমান, ব্রিটিশ, জর্ডানি, মিশরীয় এবং হাল আমলের ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি সহ এরকম বহু জাতি ও অঞ্চলের ব্যক্তি ও শাসকবর্গ। ফিলিস্তিনের অপর নাম হলোঃ পবিত্র ভূমি।
ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন
সরকারিভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ১৫ নভেম্বর ১৯৮৮ সালে আলজিয়ার্স শহরে নির্বাসনে
ঘোষিত একটি রাষ্ট্র, যেখানে
প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও) ও প্যালেস্টাইন জাতীয় পরিষদ (পিএনসি)
একপাক্ষিক ভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল । ১৯৮৮ সালে ঘোষণার সময়ে কোনো অঞ্চলেই পিএলওর নিয়ন্ত্রণ ছিল না, যদিও তারা যে অঞ্চলগুলি দাবি করেছিল
আন্তর্জাতিকভাবে সেইগুলি ইসরাইলের দখলে ছিল। ১৯৪৭ সালে জাতি সংঘ দ্বারা প্রস্তাবিত
ফিলিস্তিন বিভাগ যেভাবে প্রস্তাবিত হয়েছিল, সেখানে
ফিলিস্তিন ভূখণ্ড (গাজা ভূখণ্ড ও ওয়েস্ট ব্যাংক) ছাড়াও ইসরায়েল শাসনাধিন অঞ্চলও
ছিল এবং জেরুজালেমকে ঘোষিত রাষ্টের রাজধানী আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
১৯৭৪ সালে আরব লীগ শীর্ষ বৈঠকে স্থির হয়েছিল, পিএলও ফিলিস্তিনের জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি এবং তাদের জন্য জরুরি
ভিত্তিতে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করার আহবান জানিয়েছিল। ২২ নভেম্বর
১৯৭৪, থেকে একটি হিসেবে
জাতি >পিএলও কে "রাষ্ট্রহীন-সত্তা" রুপে
পর্যবেক্ষক অবস্থা রাখা হয়েছিল। যারা কেবলমাত্র জাতি সংঘে তাদের বক্তব্য রাখতে
পারতেন, কিন্তু ভোট দেবার কোনো ক্ষমতা ছিল না।
ফিলিস্তিন সমস্যার প্রেক্ষাপট:
ভূমধ্যসাগরের পূর্বে ১০,৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী
ফিলিস্তিন দেশটি ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীন, প্রথম
বিশ্বযুদ্ধে যারা ছিল বৃটেন বিরোধী জোটে৷ তখন যুদ্ধ জয়ের জন্য ফিলিস্তিনদের
সহযোগিতা পাওয়ার আশায় ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর যুদ্ধে
জয়ী হলে এই ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন৷ যা ইতিহাসে বেলফোর
ঘোষণা হিসেবে পরিচিত৷ যেহেতু আরবরা ছিল ইহুদিদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি, সেহেতু ঘোষণাটি তাদের অনুকূল বলেই তারা ধরে নেয়৷ কিন্তু এর মাঝে যে মহা
ধোকাটি লুকিয়ে ছিল তা তারা বুঝতে পারেনি৷ ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে৷ প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি
করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান৷ ফলে আনন্দিত ব্রিটিশ
প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন কি ধরনের পুরস্কার তিনি চান৷ উত্তর ছিল অর্থ নয় আমার
স্বজাতি বা ইহুদিদের জন্য এক টুকরো ভূমি আর তা হবে ফিলিস্তিন৷ ফলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি
ইহুদিদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয় বৃটেন৷ প্রথম
বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর বৃটেন স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর
দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে৷ মূলত এই সময়টিই ফিলিস্তিনকে আরব শূন্য বা মুসলিম
শূন্য করার জন্য ভালোভাবে কাজে লাগায় ইহুদি বলয় দ্বারা প্রভাবিত ইঙ্গ-মার্কিন
শক্তি৷
আরবদের উচ্ছেদকরণ ও ইসরায়েল
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা:
ব্রিটিশরা একদিকে ইহুদিদের জন্য খুলে দেয় ফিলিস্তিনের দরজা,
অন্যদিকে ব্রিটিশ বাহিনীর সহযোগিতায় ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের
বিতাড়িত করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য গড়ে তোলে অনেক প্রশিক্ষিত গোপন
সন্ত্রাসী সংগঠন৷ তার মধ্যে তিনটি প্রধান সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং যারা হত্যা, সন্ত্রাস,
ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনদের বাধ্য করে
নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে৷ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর গণহত্যার কথা যখন
আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল তখন পরিস্থিতকে নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য গুপ্ত
সংগঠন হাগানাহ বেছে নেয় আত্মহনন পন্থা৷ ১৯৪০ সালে এসএস প্যাটৃয়া নামক একটি
জাহাজকে হাইফা বন্দরে তারা উড়িয়ে দিয়ে ২৭৬ জন ইহুদিকে হত্যা করে৷ ১৯৪২ সালে
আরেকটি জাহাজকে উড়িয়ে দিয়ে ৭৬৯ জন ইহুদিকে হত্যা করে৷ উভয় জাহাজে করে ইহুদিরা
ফিলিস্তিনে আসছিল আর ব্রিটিশরা সামরিক কৌশলগত কারণে জাহাজ দুটিকে ফিলিস্তিনের
বন্দরে ভিড়তে দিচ্ছিল না৷ হাগানাহ এভাবে ইহুদিদের হত্যা করে বিশ্ব জনমতকে নিজেদের
পক্ষে আনার চেষ্টা করলো৷ পাশাপাশি ইহুদিদের বসতি স্থাপন ও আরবদের উচ্ছেদকরণ চলতে
থাকে খুব দ্রুত৷ এর ফলে ২০ লাখ বসতির মধ্যে বহিরাগত ইহুদির সংখ্যা দাড়ালো ৫ লাখ
৪০ হাজার৷ এ সময়ই ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে
ইঙ্গ-মার্কিন চাপে জাতিসংঘে ভোট গ্রহণ হয় তাতে ৩৩টি রাষ্ট্র পক্ষে, ১৩টি বিরুদ্ধে এবং ১০টি ভোট দানে বিরত থাকে৷ প্রস্তাব অনুযায়ী মোট
জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ইহুদিরা পেল ভূমির ৫৭% আর ফিলিস্তিনীরা পেল ৪৩% তবে
প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রটির উত্তর-পশ্চিম সীমানা ছিল অনির্ধারিত ফলে ভবিষ্যতে ইহুদিরা
সীমানা বাড়াতে পারে৷ ফলে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা চূড়ান্ত হলেও উপেক্ষিত থেকে যায়
ফিলিস্তিন। জাতিসংঘের মাধ্যমে পাস হয়ে যায় একটি অবৈধ ও অযৌক্তিক প্রস্তাব৷
প্রহসনের নাটকে জিতে গিয়ে ইহুদিরা হয়ে ওঠে আরো হিংস্র৷ তারা হত্যা সন্ত্রাসের
পাশাপাশি ফিলিস্তিনদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশে রাতে তাদের ফোন লাইন, বিদ্যুৎ লাইন কাটা, বাড়িঘরে হ্যান্ড গ্রেনেড
নিক্ষেপ, জোর করে জমি দখল এবং বিভিন্নভাবে নারী নির্যাতন করে
মৃত্যু বিভীষিকা সৃষ্টি করতে লাগলো৷ ফলে লাখ লাখ মুসলিম দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হলো
৷ এরপরই ১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২টা এক মিনিটে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করলো ইহুদিরা
৷ ১০ মিনিটের ভেতর যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিল,
অতঃপর সোভিয়েত ইউনিয়ন-বৃটেন স্বীকৃতি দিল।
এখন কথা হলো ফিলিস্তিন সমস্যার
সমাধান হয় না কেন?
এককথায় এ প্রশ্নের উত্তর: মধ্যপ্রাচ্যে সবাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে,
কিন্তু শান্তির পক্ষে নয়।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের যে প্রস্তাব অনুসারে ইসরায়েল রাষ্ট্রের
প্রতিষ্ঠা, সেই একই প্রস্তাব অনুসারে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন
রাষ্ট্রেরও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা। সাড়ে ছয় দশক পরে ইসরায়েল এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর
দেশ। আর ফিলিস্তিনবাসীর জন্য স্বাধীনতা অধরাই রয়ে গেছে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে
বিভক্ত করে দুটি রাষ্ট্র অর্থাত একটি ইহুদি, অন্যটি আরব রাষ্ট্র
গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়।
অসম ও অন্যায্য এই যুক্তিতে
ফিলিস্তিনি মুসলিমরা সে সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। উল্টো ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র
ঘোষিত হলে প্রতিবেশী চারটি আরব দেশ মিসর, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাক একযোগে ইসরায়েলকে আক্রমণ করে।
সেই যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয় এবং ইসরায়েল জাতিসংঘ পরিকল্পনায় তাদের জন্য বরাদ্দকৃত
ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ৫৭ শতাংশের জায়গায় মোট ৭৭ শতাংশ দখল
করে নেয়। এরপর যে এক চিলতে জমি পড়ে রইল, সেখানে স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা করা যেত। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে মিসর
ও জর্ডান তা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম গেল
জর্ডানের বাদশাহর কবলে, গাজার দখল নিল মিসর।
এরপর গত ৭০ বছরে আরব সাগর দিয়ে অনেক পানি বয়ে গেছে, তার চেয়েও বেশি গেছে ফিলিস্তিনিদের কান্না ও মৃত্যু।
ফিলিস্তিনিরা কি শেষ পর্যন্ত সত্যিই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাবে? ফিরে পাবে কি নিজেদের হারানো ভূখণ্ডের ওপর মালিকানার অধিকার? অন্যদের মতো তারাও কি ভবিষ্যতে নিজভূমিতে মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে? ঘুচবে তাদের ৭ দশকের বেশি সময়ের অপমান-লাঞ্ছনার উদ্বাস্তু-জীবন? সময় যত গড়াচ্ছে, এসব প্রশ্নের নেতিবাচক জবাবের পাল্লা যেন তত ভারী হচ্ছে। বরং প্রশ্ন আসছে, ফিলিস্তিনিরা কি নিয়মিতই শিকার হবে ইসরায়েলি বোমার? আর খাঁচায় বন্দী দীনহীন জীবনই কি তাদের শেষ পরিণতি?
এসব প্রশ্নের ইতিবাচক জবাবই যেন জোরদার হয়ে উঠছে ক্রমেই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুসারে, ইসরায়েল রাষ্ট্র কি না সে প্রশ্ন অবশ্য তোলা যায়। কেননা, আজ পর্যন্ত এই রাষ্ট্রটির সঠিক সীমানা চিহ্নিত হয়নি। তারপরও ইসরায়েল রাষ্ট্র তার জন্মের পর ৭০ বছর অতিক্রম করছে, ‘বিভিন্ন ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্রসহ পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা সামরিকভাবে সুরক্ষিত; বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা রাজনৈতিকভাবে সুরক্ষিত; শক্তিশালী লবি ও বেশির ভাগ পশ্চিমা বিশ্বে একই রকম গোষ্ঠী দ্বারা সুরক্ষিত; বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া মুসলমান-বিরোধী মনোভাবে উল্লসিত হয়ে ইসরায়েল এখনো বেড়ে চলেছে।
ফিলিস্তিনে চলতে থাকা এই নির্মম হত্যা যজ্ঞ-নির্যাতন সমগ্র বিশ্বের শান্তিকামী সকল মানুষকে আহত করে। আধুনিক সকল সমরাস্ত্র ব্যবহার করে ফিলিস্তিনের হাজার হাজার নিষ্পাপ শিশু ও নারীর বুক ঝাঁঝরা করে মানবাধিকারকে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করে চলছে। শান্তিকামী মানুষ হিসেবে আমরা এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।